সবূর নানার বয়স ষাটের কাছাকাছি। স্ত্রী,ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী নিয়ে বিরাট সংসার তার। থাকেন শহরে। গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে গিয়েছেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে।
পড়ন্ত বিকেল। সবাই যখন সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখছে, তখন তিনি তাকিয়ে আছেন পানির ঢেউয়ে ভাসতে থাকা ছোট কৌটাটির দিকে। ধীরে এক পা এগিয়ে ওটা খুলে ভেতরে দেখলেন পাটের দড়ি দিয়ে বাধা পলিথিনে মোড়ানো “ দু’ টুকরা চক ছাড়া আর কিছুই নেই ।” থাকবে না তো, আর যে কিছু থাকার কথা নয়। ততোক্ষণে সবাই তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছে। তার চোখ দুটো যে অশ্রুভারী!!
মুহূর্তটাই ফিরিয়ে নিয়ে যায় ছোট বেলায়। দিনগুলো সুখের ছিল না,তাহলে সেগুলো মনে থাকত না। ছোটবেলার স্রিতি গুলো তার মস্তিষ্কে জলে ফোটা পদ্মের মতই, কিছুতেই যেন ডুবতে চায় না।
বড় হয়েছে গ্রামে। গ্রাম বললে ভুল হবে, বরং অজপারাগা। এ অঞ্চলের লোকজন এখনো মান্ধাতার আমলের কাছে জিম্মি। আধুনিকতার ছোঁয়া এখানে লাগেনি-লাগার কোন সম্ভাবনাও নেই। কোনদিন কোন সাংবাদিক, সমাজসেবক বা মানবাধিকার কর্মীদের নজরে আসছে বলে মনে হয় না। আদমশুমারীরা এদের গণনা করে কিনা সন্দেহ। তবে হ্যাঁ, এখানে আছে শুধু গ্রীষ্মকালে কাঠফাটা রোদ, বর্ষাকালে অঝোরধারায় বৃষ্টি-হাঁটু অবধি কাদা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিষ্ঠুর অত্যাচার!
এমনি এক ভদ্র এলাকায় মধ্যবিত্তের ঘরে সবূরের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই অনেক বেশি ভাবুক প্রকৃতির ছেলে সে। চারপাশের হাজারো সমস্যা জর্জরিত পরিবেশ তাকে বিশেষ ভাবে নাড়া দেয়। প্রতিটি সমস্যা সে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যেন সেগুলোর সমাধান চায়।
গ্রাম থেকে প্রায় সাত-আট মাইল দূরে এক প্রাইমারী স্কুলে পড়াশুনা করে সে। প্রতিদিন পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়। পথও বেশি সুবিধার নয়। প্রথমে ক্ষেতের আইল ধরে জেতে হয়, তারপর নদী পার হওয়া, তারপর বালুচর, তারপর সরু মেঠো পথ ধরে এগুতে থাকলেই এক সময় দেখা মেলে স্কুলের। প্রতিদিন তার এই পথ হাঁটা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
প্রায়ই সে স্কুল থেকে ফিরে দেখে তার মা ঢেঁকিতে ধান ভানছে। দীর্ঘ সময় ঢেঁকিতে থাকার কারণে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ঢেঁকি থেকে নেমে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য পিড়িতে বসলে সবূর জিজ্ঞেস করে,
-মা, ক্ষেতে ধান বুনলে ধান হয় কিন্তু চাল বুনলে চাল হয় না কেন?
-চুপ কর গাধা। সময়মত খাইতে পাস তো ...।।
ধমক খেয়ে চুপ করে যায় সে। তার মা দীর্ঘদিন থেকে আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত। নলকূপের পানি থেকে আর্সেনিক কিছুতেই দূর করা যাচ্ছে না।
গ্রীষ্মকাল পুরোপুরি উপস্থিত। সূর্য থেকে রোদ নয়, যেন আগুন ঝরে পড়ছে। দিগন্তের পানে তাকালে মনে হয় দগ্ধ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ধোঁয়া সর্পিলাকারে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। বালুচরে এসময় ধান দিলে খই হয়ে যায়।
স্কুল শুরু হয় নয়টায়। দূরে হলেও সবূর প্রতিদিন স্কুলে যায়। সেদিন তার পড়া হয়নি। স্যার ক্লাসে এসেই ধমক দিয়ে বললেন,
-কার কার পড়া হয় নাই? দাড়াও।
না পড়ার দলের সবাই এদিক-ওদিক একবার দেখে নিয়ে দাড়িয়ে যায়। এদের সারিতে আজ যোগ দেয় সবূরও।
‘প্রতিদিন তো পড়েই আসি। আজ পড়া হয় নি বলে দাড়াতে হল। আচ্ছা, স্যারের এই ন্যাড়া মাথাটার ভেতরেই তো সব পড়া আছে। স্যারের মস্তিস্কের যে অংশ গুলোতে আমাদের পড়া আছে, সেগুলো যদি হুবহু কপি করে আমাদের মস্তিস্কে সেট করে দেয়া যেত,তাহলে তো সে পড়া আমরাও পারতাম। আর পড়তে হত না। আর এই প্রক্রিয়া বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে মৃত্যুর পরও তাদের গবেষণা অবিকল চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হত।’ দু’হাতে দুইকান ধরে দাড়িয়ে এমনি চিন্তা করতে থাকে সে। পড়া যে হয়নি তার কারণটাও অগ্রহণযোগ্য নয়।
গতকাল শরীরটা একটু খারাপ থাকলেও স্কুলে যায় সে। স্কুল ছুটি হয় দুইটায়। সূর্য তখন সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে মাথার উপরে উপস্থিত। নদীর পাড়ে এসে দেখে পার হওয়ার একমাত্র মাধ্যম ভেলাটা ওপারে চলে গেছে। অগত্যা পিঠপুড়া রোদের মধ্যে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
এবার তাকে স্বাগতম জানায় বিস্তীর্ণ বালুচর। এসময়ের বালু যেন মাটি নয়, জ্বলন্ত কয়লা। মাথার উপরে অগ্নিকুণ্ডের মত সূর্য আর পায়ের নিচে উত্তপ্ত বালু ঠিক যেন কামারের হাতুড়ীর নিচে বেসাইজের লোহাটুকু, সাইজ এবার তাকে হতেই হবে। এরকম বালুতে হেঁটে পায়ে ফোস্কা হয়েছে বহুবার। কিন্তু কি আর করা! পথ তো একটাই। বইগুলো দুই হাতে মাথার উপরে ধরে হেঁটে যায় সে।
বাড়ি পোঁছতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বইগুলো রেখে একটু বসার কথা ভাবতেই মা ক্ষেতে বাবার জন্য পানি নিয়ে যেতে বলে। “ পারব না” কথাটা শিখেনি সে।
বাবার চোখে–মুখে ক্লান্তির ছাপ। সকাল থেকে মাঠে কাজ করছে। সবূরকে দেখেই চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আসলি কেন? স্কুল ভাত দেয় না?
বাবাই আর কি করবে। প্রথমবার যে ধান গুলো লাগিয়ে ছিল, সেগুলো বৃষ্টির অভাবে মরে গেছে। আবার লাগিয়েছে যেগুলো সেগুলোরও প্রায় একই অবস্থা। এবার মরে গেলে আর লাগানোর উপায় নেই।
সন্ধ্যায় একটা কেরোসিনে জ্বালানো বাতি নিয়ে পড়তে বসে। অসহ্য গরম আর মশার যন্ত্রণা উপেক্ষা করে পড়ায় মনোযোগ দেয় সে।
এমন সময় বড় বোনকে নেবার জন্য তার শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক আসে। বিয়ে হবার অল্প দিন হলো। বয়স বেশি হয় নি-পনেরো কি ষোল। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় সে। বড় বোনের বিয়ের পর মাথার উপর থেকে একমাত্র ছায়াটাও যেন দূরে চলে যায়, সকল কাজের দায়িত্ব পড়ে সবূরের কাঁধে।
রান্না করার জন্য মা বাতিটা নিয়ে যায়। সবূর অন্ধকারে বসে থেকে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে।
সে দেখতে পায়-তার কাছে দুটি যন্ত্র আছে। একটি “ওয়াটার কনভার্টার” যা পানিকে ভেঙে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন পরিণত করে, অন্যটি “ কার্বন ডাই-অক্সাইড কনভার্টার” যা কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ভেঙে কার্বন ও অক্সিজেনে পরিণত করে, ঠিক গাছের মত। তারপর কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে তা দ্বারা বাতি জ্বালানো যায়, ফলে তেল কিনতে হয় না। আবার দ্বিতীয় যন্ত্রটি বায়ু থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বলে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধিও রোধ করা সম্ভব হয়।
হঠাৎ কার ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝর হচ্ছে। শোঁ শোঁ শব্দে বহমান বাতাস সমস্ত গ্রামটাকে যেন এলোমেলো করে দিচ্ছে। ঘরের মধ্যে সবাই উচ্চস্বরে খোদাকে ডাকছে।
ভোরে ঘুম ভাঙলে স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। তার কাছে যদি আরও “অ্যাণ্টি ওয়াটার কনভার্টার” নামে কোন যন্ত্র থাকত, তাহলে সে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন মিলিয়ে বিশুদ্ধ বিশেষ করে আর্সেনিক মুক্ত পানি তৈরি করতে পারত।
বাইরে আসলে ঝরের কথা মনে পড়ে। বাঁশঝারের আড়ালে থাকার কারণে শোবার ঘরটা কোনমতে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু নড়বড়ে রান্না ঘরটাকে কিছুতেই ছাড় দেয় নি ঝরের দেবতা। ঘরের চাল, রান্নার তৈজসপত্র সব কিছুই উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
বাড়ির চারপাশে নিজেদের জিনিস গুলো খুঁজতে গিয়ে সবূরের এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে। তার বন্ধু নাকি একটি যন্ত্র দিয়ে হারানো জিনিস খুজে বের করতে পারে। “লস্ট সার্চার” নামক ঐ যন্ত্রে প্রত্যেকটি জিনিসের গায়ে একটি কোড নাম্বার লিখে সেই কোড সহ জিনিসটার একটি ছবি ইনপুট দিতে হয়। পরে কখনও জিনিসটা হারিয়ে গেলে যন্ত্রে ঐ ছবি নির্বাচন করে দিতে হয়। এটি নির্দিষ্ট তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের বিকিরণ নির্গত করে চারপাশের নির্ধারিত এলাকাকে স্ক্যান করে এবং যেখানে ঐ জিনিসটা আছে তার মানচিত্র সহ যাওয়ার সম্ভাবনাময় সকল পথ দেখিয়ে দেয়।
-কিন্তু স্যারের তো এসব নয়,পড়া চাই।
আষাঢ় মাসের কথা। টানা বৃষ্টির কারণে তলিয়ে গেছে গ্রাম। বালুচর তখন স্রোতস্বিনী নদী।
স্কুলে পরীক্ষা চলছে। সূর্যটা মেঘে ঢাকা থাকার কারণে ঘরের ছায়াটাও দেখা যাচ্ছে না। অনুমান করে বের হতে একটু দেরী হয়ে যায়। হাঁটু অবধি কাদা আর পানি ভেঙে স্কুলে যেতে হয়। এরকম পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়-তার কাছে যদি অভিকর্ষরোধী কোন জুতা থাকত। যে জুতা পড়লে তার উপর ক্রিয়াশীল অভিকর্ষ বল নিষ্ক্রিয় হয়ে যেত। ফলে সে পানির উপর দিয়ে হেটে যেতে পারত।
নদীতে ভেলাটা তখন প্রায় তীরে পৌঁছেছে। এমন সময় স্রোতে একটু কাত হয়ে গেলে পাশেরজন সবূরকে অবলম্বন করে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে দু’জনই পানিতে পড়ে যায়। সাতরে তীরে উঠে শার্টটা একটু নিংড়ায়ে নিয়ে দ্রুত চলে যায় সে। ইতোমধ্যেই পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু পকেট হাতরে আর চক খুজে পায়নি সেদিন।
বন্যার পানি আরও বেড়ে যায়। ফসল নষ্ট হওয়ার ভয়ে কৃষকেরা হা-হুতাশ করতে থাকে। স্কুলে যাওয়া বন্ধ। ঘরে বসে দাদুর কাছ থেকে গল্প শুনে। দাদুর গল্প গুলোও ভাববার মত। গল্পের রাজকুমার নাকি মেঘ নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। অসময়ের এই বৃষ্টি সে মরুভূমিতে নিয়ে ফেলত। ফলে এসব অতিবৃষ্টি, বন্যা, ক্ষয়ক্ষতি কিছুই হত না।
হাড়ভাঙা শীতেও পাতলা একটা কাপড় পরেই সবূর স্কুলে যায়। বন্যার সময় স্কুলে যায় নি বলে তার উপবৃত্তির নাম কাটা যায়। এ জন্য চাপা ক্ষোভ রয়েছে তার। এতেই কি শেষ!
ক্রীড়া শিক্ষক স্কুল ড্রেস বানাতে বলেছে। তা না হলে মাঠে সবার সামনে কান ধরে উঠ-বস করায়। আজ স্কাউটে লাইনে দাড়িয়ে চিন্তা করে তার শার্টের রঙটা যদি পাল্টানো যেত। স্যার তাকালেই সেটার রং নেভি ব্লু আর আর না তাকালেই খয়েরী।
এরকমই ছয় ঋতুতে ছত্রিশরুপী সমস্যার মধ্য দিয়ে সে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোয়। বন্ন্যায় বালু পড়ে আবাদি জমি নষ্ট হওয়ায় একবার তো পড়াশুনা বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। তখন সহায় হয় তার বড় বোন। বোন জামাইয়ের আর্থিক সহায়তায় সে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে। প্রাইভেট না গিয়ে রুমে বসেই পড়ত। এজন্য বন্ধুরা তাকে ডিম নিয়ে বসে থাকা ‘মুরগী’ বলতেও দ্বিধাবোধ করত না। এসব অপমান সে ন্যায্য প্রাপ্য মনে করে নীরবে সইত।
উচ্চ মাধ্যমিক শেষে দেশের স্বনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে। পি এইচ ডি করার জন্য বিদেশ যায়। তার গবেষণার বিষয় হয়-এমন এক তরল পদার্থ যা মানবদেহের রক্তে প্রবেশ করালে টা রক্তের কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অক্সিজেন পরিমাণ বাড়িয়ে-কমিয়ে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর ফলে গ্রীষ্মকালের গরম ও শীতকালের ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দেহের ও পরিবেশের তাপমাত্রা সমান থাকে বলে শরীর ঘামে না। কোনও ক্ষতিকর জীবাণুও দেহে আক্রমণ করতে পারে না। মানবদেহের উপকারী এই তরলের জন্য একনিষ্ঠ ভাবে সাধনা করে যায় সে।
আজ সবূর “সে” থেকে “তিনি” হয়ে যায়। বিশ্ববাসী তাকে বিজ্ঞানী হিসেবেই চেনে।
ঐ রাতেই সবূর নানা আমাদের গ্রামের গল্প শুনান। অতীতের কথা মনে করে কেঁদে ফেলেন তিনি। কষ্টের স্রিতিগুলো বলতে বলতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন, যে ঘুম থেকে আর জেগে ওঠা হয় নি তার। তিনি ঘুমাচ্ছেন, পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন।
হয়তো তার এই আজগুবি চিন্তা-ভাবনা একদিন বাস্তবে পরিণত হবে। কিন্তু তার ফল ভোগ করবে কে? ঐ শহরবাসীই। গ্রামের বাসিন্দারা আজ যে রকম রয়েছে, কালও সে রকমই থাকবে। তাদেরকে বিধাতাই যখন গ্রামের করে বানিয়েছেন,তখন মানুষের করার কি আছে??
No comments:
Post a Comment