Wednesday, December 11, 2013

সায়েন্স সন্ধ্যা

 

সব্দল হাট।

প্রতিদিন বিকালে ছোটখাটো একটা বাজার লাগে, আর শনিবার ও মঙ্গলবারে লাগে হাট। হাটের দিন থাকে প্রচন্ড মানুষের ভীর। গরম জিলাপি থেকে শুরু করে সাপ দেখিয়ে মাদুলি আর হেকিম চাচার কবিরাজি ওষুধ বিক্রিও বাদ যায় না।

আজ শনিবারের হাট। পিংকু হাতে একটি চটের ব্যাগে পাঁচ কেজি ধান নিয়ে এসেছে। ধানের দামটা প্রতি বার-ই উঠা-নামা করে। সে একশত টাকা পেল ধানগুলো বিক্রি করে। পিংকুকে দেখা গেল এদিক-সেদিক ঘুরে বেরাতে। লোকের গিজ গিজ ঠেলে পিংকুর হাতের খালি চটের ব্যাগটা সামনে-পিছনে দুলছে। এমন সময় কিম্ভূতকিমাকার একটা মানুষ ভীর ঠেলে ঠেলে পিংকুর দিকে আসছিল। লোকটির পেটটি সামনে নীল শার্টের বোতাম ছিড়ে বের হতে চাইছে। চুলগুলো সাদা। বয়সের ভার মুখের চামড়াতে একেবারে স্পষ্ট। পিংকু তার সাথে কথা বলতে গেল।

পিংকুঃ       নমস্কার, আমার ভাগ্যটা মনে হয় খুব ভালো আজকে। আপনি সেই বিজ্ঞানী হরেণ চ্যাটার্জী, তাই না?

হরেণ চ্যাটারজীঃ হ্যা, ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু আমিতো. . .

পিংকু হরেণ চ্যাটার্জীকে থামিয়ে বলে-

- আমাকে চেনার কথা আপনার নয়। আসলে জানেন কি-বিখ্যাত লোকেরা অনেকের কাছেই পরিচিত। কিন্তু সেই ‘অনেকের’ সবাইকে কি ঐ ভদ্র বিখ্যাত লোকটি চেনেন?

- তা যা বলেছেন বাবু। আপনি তাহলে আমার জাদু দেখেছেন কোন স্কুলে, তাইনা?

- হ্যা, আমাদের স্কুলেইতো দু’বার দেখালেন।

- তা আপনার পরিচয়টা. . . .

- একি! আপনি আমার বাবার বয়সী। আমাকে ‘তুমি’ করে বললেই খুশি হব। আর-আমার পরিচয়! মানুষের পরিচয়তো ক্ষণে ক্ষণেই পালটায়। কোনটাইতো  স্থায়ী নয়।

- একেবারে পাক্কা কথা বলেছেন, না না বলেছ। তা তোমার বর্তমান ক্ষণের পরিচয়টাই বল।

পিংকু একটু সময় নিয়ে চিন্তা করে বলল-

- আমি পিংকু  রায়। একটা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছি। আর দু’বছর হল-নিজেই একটা ছোটখাটো থিয়েটার করেছি। সেখানেই বেশির ভাগ সময় কাটে।

- বাহ! বেশতো। তোমার থিয়েটারে একদিন আমাকে নিয়ে যেও।

- নিশ্চয়ই নিয়ে যাব। আপনি জানেন না আমি আপনাকে কত খুজেছি। এমন লোক আপনি, মোবাইল ছাড়া এখন কি কল্পনা করা যায়। একজন রিক্সাচালক- যে কিনা পেটে ক্ষুধা লাগলেও পাঁচ টাকা না খেয়ে বাচ্চার জন্য ক্রিম বল কেনে , সে-ই এখন মোবাইল কিনেছে। কেন জানেন-বউয়ের সাথে কথা বলবে বলে। বউয়ের সাথে কথা মোবাইলে বললে নাকি তার রিক্সা চালানোর কষ্টটা গায়ে লাগেনা।

- তা বুঝলাম, আমি কার সাথে কথা বলব?

- আপনার না হয় কথা বলার লোক নেই, কিন্তু আপনিইতো অন্য কারো কথা বলার লোক হতে পারেন, তাইনা?

- হ্যা, ঠিকই বলেছ। তবে. . . .

-তা যাইহোক, আমি আপনার জাদুর ফ্যান সেই ক্লাস সিক্স থেকেই। আমাদের স্কুলে তখন প্রথম দেখেছিলাম আপনাকে। আপনি তখন তো ইয়াং ম্যান, আর বলতেন-এগুলো কোন জাদু নয়, সব সায়েন্স। আমি তখন বুঝতে পারিনি জাদু কেন সায়েন্স হবে? পরে যতই বড় হয়েছি , বুঝেছি সায়েন্স কত মজার বিষয়। আপনার খোঁজে বেরিয়েছি এই আশায়-কিছু সায়েন্স শিখব।

 

বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে। সেটা হরেণ বাবুর ঠোঁট কাঁপুনি দেখেই ঠাহর হয়। কথোপকথন আর বেশি দূর এগোলনা। হরেণ বাবু তার বাড়িতে পিংকুকে আসার নিমন্ত্রন দিয়ে একটা কাগজে ঠিকানাটা কাঁপা- কাঁপা হাতে লিখে দিলেন। হরেণ বাবুর এক প্রতিবেশী হরেণ বাবুকে বাইকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। আর পিংকুর তো মাথায় হাত! মা যে তরকারি – পাতি কিনতে বলেছিল! কাঁচা বাজারে প্রায় সব কিছু শেষের দিক। ভেন্ডি কিনল ২ টাকা প্রতি কেজি দরে। একশ টাকায় ব্যাগ ভর্তি!

 

 

২.

উমেদ আলি হাই স্কুল।

নবম শ্রেণীর ক্লাশ রুমে পিংকু ঢুকল। দিনের প্রথমেই পিংকুর পদার্থ ক্লাস। পিংকু বলল-

- তোমরা কি কেউ ফানুস দেখেছ? বলতে পারবে কেন ফানুস আকাশে উরে যায়?

কেউ কেউ দুই হাত তুলেছে, আবার কেউ এক হাত, কয়েকজন তোলেইনি-তারা মনে হয় ফানুস দেখেনি, না হলে স্যারের কথা ভালো মত বোঝেইনি। পিছনে গল্প করলে বুঝবে কিভাবে?

পিংকুঃ       সবাই হাত নামাও, জামান তুমি বল।

জামানঃ স্যার, আমি ফানুস কল্পনায় দেখেছি। আমার দাদু আমাকে বলেছিল- ফানুস আর মানুষ এই দু’য়ের মাঝে অনেক মিল। ফানুসের দম হল কেরোসিনে ভেজানো দড়ি, যতক্ষণ জ্বলবে – ততক্ষণ আকাশে উড়বে। কেরোসিন শেষ, ধুপ করে মাটিতে পরে যাবে।

পিংকুঃ       থামো!! সাহিত্য বলা শুরু করেছ? মিতালি, তুমি বল।

মিতালিঃ অ্যাঁ. . . উমম. . . স্যার. . .

পিংকুঃ       বলো বলো।

মিতালিঃ স্যার, হালকা জিনিস  তো ভারী জিনিসের উপর ভাসতে পারে। ফানুসের ভিতরে যে ধোয়াটা থাকে সেটাতো অনেক গরম এবং এই জন্যই হালকা, তার আশেপাশের বাতাসের চেয়ে। আমার মনে হয় এই জন্যই ফানুস উপরে ভাসতে থাকে, আর বাতাস এসে তাকে ঠেলে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়।

পিংকুঃ       এক্সাক্টলি। বসো। দেখেছ! সবাই মিতালির মত চিন্তা করতে শেখ। তাহলেই সায়েন্স পড়তে ভালো লাগবে। সেই সাথে আমাদের দেশটাও অনেকদূর এগিয়ে যাবে।

মিতালিঃ স্যার, আমার একটা প্রশ্ন আছে।

পিংকুঃ       কি প্রশ্ন বল। আমি প্রশ্ন করাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করি।

মিতালিঃ স্যার, একটা পেরেক হাতের মধ্যে জোড়ে টিপে দিলেও ঢুকেনা, কিন্তু একটা শুই দিয়ে  অল্প একটু চাপ দিলেই ঢুকে যায় কেন?

পিংকুঃ       বাহ! মিতালি। তোমার প্রশ্নটা খুবই মজার। তোমাদের মত ছেলে-মেয়েদের জন্য বাংলাদেশ সত্যিই গর্বিত। বাংলাদেশ বদলে যাচ্ছে, এটা তারই একটা প্রমাণ।

শোন- তোমার প্রশ্নের মধ্যেই কিন্তু একটা ক্লু আছে। ফোর্স বেশি দিচ্ছ কিন্তু ঢুকছেনা, আবার ফোর্স কম দিলেও কোন কিছুতে সেটা ঢুকে যাচ্ছে। তার মানে ফোর্স দিয়ে বিষয়টাকে পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছেনা। তাই একটা নতুন রাশি চাপ, যেটা হল প্রতি একক ক্ষেত্রফলে ফোর্স। এ থেকে বোঝা যায় একই ফোর্সের জন্য ক্ষেত্রফল কম হলে চাপ বেশি, এবং ক্ষেত্রফল বেশি হলে চাপ কম, তাই না?

মিতালিঃ জী স্যার।

পিংকুঃ       শুই হল চিকন , মানে এর মুখের ক্ষেত্রফল অনেক কম । আবার পেরেক কিন্তু শুইয়ের চেয়ে অনেক মোটা, মানে ক্ষেত্রফল অনেক বেশি । এখন তুমি চিন্তা কর আমি একটু আগে কি বলেছি । শুইয়ের ক্ষেত্রফল কম – মানে চাপ বেশি , যার চাপ বেশি সেইতো আগে ঢুকবে , তাইনা ?

মিতালীঃ জ্বী স্যার, বুঝে গেছি, দারুণ মজার । আর আপনি আরো মজা করে বুঝিয়েছেন । ধন্যবাদ স্যার ।

পিংকুঃ       একজন মজা পেলেই হবে শুধু , সবাইকে পেতে হবে । একা একা কি দেশটাকে ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে , সবাই মিলে ঠেলতে হবে কেউ চাকা , কেউ বডি , কেউ স্টিয়ারিং ধরবে – তবেই  না আমাদের সোনার বাংলা গড়তে পারব । তার মানে সবাইকে পড়ালেখায় মজা পেতে হবে, মজা না পেলে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা আছে ।

সবাই একসাথে বলে উঠে – স্যার , আমরা সবাই মজা পেতে চাই ।

পিংকুর চোখের কোনায় একবিন্দু জল চলে এসেছে, সে খুব আবেগপ্রবণ । দেশকে ভালোবাসার কথা উঠলে তার চোখে জল আসবেই ।

পিংকু একটু ভারী কন্ঠে বলল-

পিংকুঃ       আমিও তোমাদের মজায় মজায় শেখাতে চাই । তোমরা কি জান – যে এমন কিছু আলো আছে যেগুলো আমরা চোখে দেখিনা । কিন্তু সেই আলো গুলো জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে আমাদের আশে পাশে ঘুরে বেরাচ্ছে ?

সবাই একসাথে বলে উঠল – না স্যার , কই??  এরকম কিছুই তো জানিনা । ভূত-টূত নাকি স্যার?

পিংকুঃ       আরে, ভূত-টূত না । ঐ আলোর নাম ইনফ্রারেড আলো । তোমাদের বাড়িতে যে টিভি রিমোট আছে, তার মাথায় একটা ছোট লাইট আছে, দেখেছো কখনো ? সেটা কি জ্বলে?

হরিঃ জ্বি স্যার দেখেছি । কিন্তু জ্বলেনাতো ।

পিংকুঃ       জ্বলে , জ্বলে । এখান থেকে যে আলো বের হয় সেটা ইনফ্রারেড , আমাদের চোখ সেটা দেখতে পায় না । তোমরা বাসায় গিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করবে ।

জামানঃ স্যার , এক্সপেরিমেন্ট কি ?

পিংকুঃ       এক্সপেরিমেন্ট হল – বইয়ের জ্ঞানগুলোকে চোখ দিয়ে বাস্তবে দেখা, হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে ।

আচ্ছা শোন- বাসায় গিয়ে তোমরা মোবাইলে ক্যামেরা অন করবে, তারপর রিমোটের লাইটের উপরে ধরবে । রিমোটের বাটন চাপলে, ক্যামেরায় দেখবে লাইটটা জ্বলছে । যাদের বাসায় টিভি রিমোট বা ক্যামেরা মোবাইল নাই, তারা বন্ধুদের বাসায় যাবে যাদের টিভি রিমোট এবং ক্যামেরা মোবাইল আছে। ওকে আজ এ পর্যন্তই ।

বেশি কথা বললে পিংকুর মাথা ব্যাথা করে । এখন ক্লাশ থেকে বের হয়ে তার খুব মাথা ব্যাথা করছে । তাই ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেল ।

 

 

 

৩।

বেলা পড়ে এসেছে ।

স্নিগ্ধ রোদ এসে পড়েছে বিজ্ঞানী হরেণ চ্যাটার্জীর বাড়ির ছাদে । আকাশে অনেকগুলো চিল উড়ে বেড়াচ্ছে । বাড়ির পাশেই মেঠোপথ একে-বেঁকে চলেছে ।

মনা, হরেণ চ্যাটার্জীর মেয়ে, বিকেলের ঘুম শেষে সেজে গুজে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ছাদে উঠে এলো, একটা গল্পের বই নিয়ে । আকাশে উড়ন্ত চিল দেখতে দেখতে মনা ভাবল এরোপ্লেনের কথা । এই চিলের উড়ানো দেখেই তৈরি হয়েছে উড়োজাহাজের মডেল । চিলের ডানাগুলো কেমন যেন – উপরের দিকটা থ্যাবড়ে যাওয়া টিনের চালের মত , আর নিচটা সমতল।

মনার ধ্যান ভাঙল মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসা এক আগুন্তুক দেখে । লম্বায় প্রায় ৫ ফুট ৮ইঞ্চিতো হবেই । পড়নে সাহেবী পোশাক, মাথায় হেট, চোখে চশমা । এইরকম স্মার্ট ছেলেকে এই মেঠোপথে খুব কমই দেখাছে মনা। ছাদের রেলিং এর জন্য আর দেখা গেলানো, কোথায় যেন হারিয়ে গেল দৃষ্টি সীমানা থেকে । একটু পরেই বাসায় কলিং বেলের আওয়াজ । মনা নিচে নেমে গেল । দরজা খুলতেই দেখা গেল সেই মেঠোপথের লোকটিকে !

ভদ্রলোকঃ নমস্কার। এটা কি হরেণ চ্যাটার্জী কাকুর বাড়ি ।

মনাঃ    আজ্ঞে, হ্যাঁ । কিন্তু আপনি ?

ভদ্রলোকঃ আমি. . ., আমাকে আপনি চিনবেননা। আমি কাকুর কাছে এসেছি, কথা বলতে।

মনাঃ    ভিতরে আসুন । আপনি বসুন, আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি ।

পিংকু ঘরের চারপাশটা লক্ষ্য করছিল। ড্রয়িংরুমটা বেশ সাজানো । বেশ কিছু বিদেশী বিজ্ঞানীদের ছবি দেয়ালে টানানো । স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু’র ছবিও আছে দেখছি । নিশ্চয়ই এগুলো হরেণ বাবুর সদিচ্ছা । উত্তরের দেয়ালটার বড় একটা অংশ জুড়ে ডিজিটাল ঘরি-সবুজ আলোয় ভেসে উঠেছে ০৪:৩০ বিকাল, ২৪/০৮/২০৪৫ ।

এরপর হাতসেলাই করা একটা কবিতার ফ্রেম চোখে পড়ল । কবিতা পড়তে যাবে এমন সময় হরেণ বাবুকে নিয়ে মনা রুমে ঢুকল ।

হরেণ বাবুঃ     পিংকু বাবু যে! অবশেষে এই অধম হরেনের বাসায় আসার সময় হল ।

নমষ্কার  জানিয়ে পিংকু বলল-

পিংকুঃ        কি যে বলেন কাকু । আপনাদের সাথে সময় কাটানো তো ভাগ্যের বিষয় । আমিতো আসার জন্য উদগ্রীব । থিয়েটার আর স্কুল নিয়ে পেরে উঠছিলাম না । আজ সকালে ক্লাশ শেষে মাথাটা একটু ধরে উঠল । ভাবলাম ছুটি নিয়ে বাড়ি যাই ।

হরেণ বাবুঃ     এখন কেমন বোধ করছ বাবা ?

পিংকুঃ       এখন ভালো। ভাবলাম বিকেল বেলাটা আজ আপনার কাছে চলে আসি না কেন ?

হরেণ বাবুঃ     বেশ ভালোই করেছ । বিকেল  বেলাটা খুব একা একা লাগে । শুধু গল্প করতে মন চায় । খুব ভালো হল ।

মনাঃ    বাবা তোমরা গল্প কর, আমি তোমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করি ।

এই বলে মনা ভিতরে চলে গেল ।

হরেণ বাবুঃ     মা মরা মেয়েটাকে বুকে আগলে মানুষ করেছি বাবা । জন্মের তিন বছর পরই ওর মা মারা যায় । তারপর থেকে বাপ-মেয়ে এই দুজন মাত্র এই বাড়ির সদস্য । আর আছে একজন কাজের লোক।

পিংকুঃ       তা... কিসে পড়াশোনা করছে ।

হরেণ বাবুঃ     তারাকান্ত সরকারি কলেজ । উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষ । ওর বিজ্ঞান খুব পছন্দ । ওকে বললাম, “তোর যেটাই পছন্দ সেটাই পড়, মা ।”

পিংকুঃ       ঠিকই করেছেন ।

এর মধ্যে মনা চা নিয়ে চলে আসে ।

হরেনঃ মা মনা পরিচিত হও ওর সাথে । ও হল পিংকু, পিংকু এই হল আমার মা- মনা ।

মনাঃ    চায়ে কি কফি দিব, পিংকু বাবু ।

পিংকুঃ       হ্যা, বেশ ভালোই লাগে চা-কফি একসাথে খেতে । কাকুর মুখে শুনলাম- আপনি বিজ্ঞান অনেক পছন্দ করেন । আজকে চা খেতে খেতে হয়ে যাক না একটা বিজ্ঞান সন্ধ্যা ।

হরেণ বাবু ও মনা একসাথে সম্মতি জানালো ।

মনাঃ    আপনিই শুরু করুন না যেকোন একটা বিষয় নিয়ে।

পিংকুঃ       স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে দিয়েই শুরু করা যাক। রেডিও আবিষ্কার কিন্তু জগদীশ চন্দ্র বসুই করেছিল, মারকোনি নয় ।

মনাঃ    কি বলছেন? বইতে যে পড়লাম – মারকোনি !

হরেণ বাবুঃ     ঐটা ভুল পড়েছ মা । গোটা বিশ্ববাসীকে ভুল জানানো হয়েছে ।

পিংকুঃ       ঠিক বলেছেন কাকু । যে যন্ত্রের মাধ্যমে তার ছাড়াই তথ্য পাঠানো যায় সেটা হল ‘কোহেরার’ ।

এটা জগদীশ স্যার একাই বানিয়েছেন । কিন্তু এই ডিভাইসের পেটেন্ট নেননি । আর এই সু্যোগ কাজে লাগিয়ে মারকোনি একটু পরিবর্তন করে কোহেরার ব্যবহার করে রেডিও বানান এবং পেটেন্ট করে নেন নিজের নামে । তাই না কাকু ?

হরেণ বাবুঃ     ঠিক, একদম খাটি কথা । এই কথা সবাই জানেনা । সবাইকে জানানো উচিত আমাদেরই।

মনাঃ    এই সত্যটা এতদিন চাপা ছিল কেন ?

পিংকুঃ       বিদেশীদের কুটনীতির কারণে । সত্য চিরকাল চাপা থাকেনা মনা, থাকেনা ।

হরেণ বাবুঃ     আচ্ছা, আমি মোবাইলের রেডিয়েশন নিয়ে একটু বলব । অনেকে বলে যে মোবাইলের রেডিয়েশনে মানুষের ক্যান্সার হয় ।এটা আসলে একটা ভুল কথা । কোয়ান্টাম মেকানিক্সে প্রথমেই বলা হয় , কোন মেটাল থেকে ইলেকট্রন বের করতে হলে একটা ফোটনের মিনিমাম শক্তি দরকার হয়, যেটাকে বলা হয় ওয়ার্ক ফাংশন । বেশি শক্তি মান ফোটনের কম্পাঙ্ক বাড়া । আলোর তীব্রতা বেশি হলেই ফোটনের শক্তি বাড়েনা । এই যেমন ধর, একটা ৫০ কেজি পাথর উঠানোর শক্তি যদি আমার না থাকে, তাহলে কি আমি ঐ পাথরটি উঠাতে পারব ? পারবনা- ছুড়ে মারা তো দূরে কথা । ঠিক তেমনি – মোবাইলের রেডিয়েশনের শক্তি এত কম যে মানুষের একটা কোষকে সে ভাঙ্গতে পারে না । কিন্তু এক্স-রে এর অনেক শক্তি , ও যেদিকে যায় সব কোষ মেরে চলে যায় । তাই মোবাইল রেডিয়েশন দিয়ে মানুষের ক্যান্সার হয় কথাটা ভুল ।

পিংকুঃ       হুম্‌... দারুণতো !

মনাঃ    খুব সুন্দর ব্যাখ্যা বাবা । আমার মাথায় একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে । চিলের উড়তে না হয় পাখা লাগে , বিমানের পাখাগুলো কি কাজ করে ? অবশেষে হঠাত ব্যাখ্যাটা মাথায় চলে আসলো ।

হরেণ বাবু আর পিংকু অবাক হয়ে বলল – বলো,বলো...

মনাঃ    বিমানের পাখার উপরটা থাকে অসমতল, একটু উপরে উঠানো , আবার নিচের দিকে নামানো । আইডিয়াটা মনে হয় চিলের ডানা পর্যবেক্ষণ করে নেয়া । আর পাখার নিচের তলটা সমতল । এতে উপরের বাতাসটিকে তুলনামুলক বেশি পথ অতিক্রম করতে হয়, নিচের বাতাসের চেয়ে । এতে কি হয় জানো – পাখার উপরে থাকে কম চাপ, আর নীচে থাকে বেশি চাপ। এইটা জানা যায় আসলে বারনৌলির ইকুয়েশন থেকে । এতে করে নিচের বাতাস উপরে একটা উর্ধমুখী চাপ দেয় । এই চাপ এর কারণেই বিমান আকাশে উড়তে থাকে ।

পিংকুঃ       তোমারটা দারুণ । এসব কোথায় জেনেছ মনা ?

মনাঃ    আমি ইন্টারনেট থেকে পেয়েছি তথ্য গুলোর তারপর নিজের মত করে গুছিয়ে বলা, এইতো । দাড়ান আমি আপনাকে একটা জিনিস দেখাই । এই বলে ড্রয়ার থেকে একটা মোড়ানো কি যেন নিয়ে এসে দাড়ালো পিংকুর কাছে ।

পিংকুঃ       কি এটা ?

হরেণ বাবুঃ     আশ্চর্যজনক বস্তু!!, পিংকু , দেখোই না! আমার চেয়েও বড় জাদু দেখাবে আমার মেয়ে ।

মনাঃ    এটা একটা কম্পিউটার , সাধারণ নয় – কোয়ান্টাম কম্পিউটার । এটা তৈরি গ্রাফিন দিয়ে । গ্রাফিন হলো কার্বনের অন্য একটি রূপ । এটির মধ্যে দিয়ে কারেন্ট পাস করলে এটি গরম হয়না, এটিকে মুড়িয়ে রাখা যায় । তাই আমার এই কম্পিউটার টিকে মুড়িয়ে রাখা অসম্ভব কিছু না।

পিংকুঃ       সত্যিই তো তুমি আমাকে জাদু দেখালে । এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার আবিষ্কার করেছেন কে ?

মনাঃ    আমদের দেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পদার্থ বিজ্ঞানী ২০২১ সালে এই কম্পিউটার প্রথম আবিষ্কার করেন ।

পিংকুঃ       আপনাদের এখানে অনেক ভালো সময় কাটলো ।আজ উঠি অন্য আরেক দিন আসব ।

মনাঃ    আসবেন কিন্তু ।

পিংকুঃ       অবশ্যই আসব । আমার মত অনেক পিংকু হরেণ চ্যাটার্জীর মত মানুষের সাথে দেখা করুক এটাই আমি চাই । এভাবেই বিজ্ঞান ভালোবেসে এগিয়ে নেব আমাদের বাংলাদেশকে।

মনাঃ    অদ্ভুত সুন্দর আপনার কথাগুলো , মনে থাকবে ।

2 comments: