বায়ু শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন একেবারে নতুন কোন ধারনা নয়। এই ধারনাটির যাত্রাটি শুরু হয়েছে গত শতাব্দি থেকে। পূর্বে মানুষ বায়ু শক্তি দিয়ে নদীতে পাল ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থানে নৌ পথে গমনাগমন করতো। আধুনিক যুগে পদার্পন করে মানুষ বাতাসের বহুবিধ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তর চিন্তা ভাবনা করে। ফলে একটা সময় এসে বাতাসের গতি শক্তির মাধ্যমে এক অভিনব পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা চিন্তা করে। বায়ু শক্তি কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টির বিজ্ঞানীদের নিরন্তর প্রয়াস মানব সভ্যতাকে বিকাশমান করার ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। কেননা পৃথিবীর মানুষ একদা প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল, নবায়নযোগ্য শক্তি সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের বিশাল সোপান তখনো অবারিত হয় নি। বায়ু শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদণের যে স্বপ্ন বিজ্ঞানীরা মানব জাতিকে দেখিয়েছিলেন তা পৃথিবীর মানুষকে অনেক আশাবাদী করে তুলেছিল। যেহেতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে বায়ুশক্তি অন্যতম যা ব্যবহার করে প্রচলিত জীবাষ্ম জ্বালানির মতো বৃহৎ পরিসরে বিদ্যৎ উৎপাদন করা সম্ভব । তাই বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নিরলস গবেষনায় লিপ্ত আছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অজস্র বিজ্ঞানীরা।
বাতাসের গতিশক্তির সাহায্যে খুব সুনিপুন ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতি বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেই ক্রান্ত হননি, বরং আরও উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। বর্তমানে তুলনামূলকভাবে উন্নত পন্থায় বায়ুশক্তি চালিত টারবাইন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদণ করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে বায়ু যখন টারবাইন ব্রেডের মধ্য দিয়ে যায় তখন বায়ুর শক্তি ঐ ব্লেডগুলির সাথে রোটর সংযুক্ত থাকে যা ব্লেডগুলোর ঘূর্ণনের ফলে সক্রিয় হয়। আবার ঐ রোটর জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত থাকে যা ঘূর্ণনের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। বায়ু টারবাই্ন একটি টাওয়ারের উপর থেকে অধিকাংশ শক্তি ধারন করে থাকে। বায়ুর গতিশক্তি ব্যবহার করে এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন অন্যান্য বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতির মতো কার্বনডাই অক্সাইড সৃষ্টি করেনা। ফলে বায়ুশক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদণ পরিবেশের জন্য বেশ উপকারী।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা খুব স্বল্প পরিমানে বায়ু শক্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন। ১৯৮২ সালে একটি প্রাথমিক গবেষণায় দেশের ৩০টি আবহাওয়া তথ্য স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে যে প্রতিবেদন দেয়া হয় সেখানে দেখা যায় যে,চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা থেকে প্রাপ্ত বায়ুগতি ছিল শুধুমাত্র বায়ু শক্তি উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত।একটি বায়ু পাম্প সেট পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম বাংলাদেশ প্রথমবারের মত মুহুরি বাঁধ এলাকায় একটি ০.৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সম্পন্ন বায়ু শক্তি পাইলট প্রকল্প শুরু করে যা জাতীর পাওয়ার গ্রিডের সাথে সংযুক্ত।বিশ্ব বায়ুশক্তি পরিষদ এর রিপোর্ট অনুসারে, বায়ুশক্তির মাধ্যমে ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বের বিদ্যুৎ চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ পুরণ করা সম্ভব হবে।তাদের হিসাবে, বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫,৪০০ টেরাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। যদিও পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশ সমূহ যদিও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অজস্র সম্ভাবনা থাকলেও অগ্রগতি বেশ ধীর। কারণ বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তথ্য উপাথ্যের দুষ্প্রাপ্যতা বিদ্যমান। বাংলাদেশে মাত্র দুটি বায়ু বিদ্যাৎ প্রকল্প বর্তমানে সক্রিয় আছে। যদিও সমসাময়িককালে বায়ু শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার প্রয়াসে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশের সাথে সমঝোতা স্মারক করছে যা মূলত বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে অনেকখানি বৃদ্ধি করেছে।যদিও ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের একটি চমৎকার উদ্যোগ পরিলক্ষ্যিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার সর্বাধিক ৫টি স্থানে এক বছর ব্যাপী বায়ুশক্তির সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। স্থানগুলো হলো-ফেণীর মুহুরীদাম, কক্সবাজার, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কুয়াকাটা ও খেপুপাড়া। সমীক্ষার পর সবচেয়ে উপযোগী স্থানে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের পরিকল্পনাও হাতে নেয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলোপরিশেষে এই পরিকল্পনাটির সন্তোষজনক অগ্রগতি হয় নি।
বাংলাদেশে বায়ু প্রবাহের মাত্রার হিসেবে মহেমখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বিপ হাতিয়ার মতো সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ উয়িন্ডমিল টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বেশ উপযুক্ত। বায়ুশক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এটি শক্তির একটি অফুরন্ত উৎস। প্রকৃতি তার অমোঘ বিধানে আমাদের বাতাস দিয়ে চলেছে অনন্তকাল ধরে।এর কোনো মেষ নেই। তাছাড়া আমাদের দেশ মূলত গ্যাস বিদ্যুৎ প্রকল্পের উপর খুব বেশী নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৮৬ শতাংশ জ্বালানী চাহিদা মেটানো হয় গ্যাস দিয়ে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান। কেননা গ্যাস হচ্ছে অনাবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। ফলে যদি আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বায়ুশক্তির বিকল্ক উৎসের কথা না চিন্তা করে তবে একটা সময় আমাদেকে বিরাট সমস্যার মুখে পতিত হতে হবে। তাছাড়া, বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তির যথাযত ব্যবহারের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে বসবাসরত মানুষের জীবনমানও উন্নত করা সম্ভব। এসব এলাকার মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম হল মৎস আহরন। কিন্তু মৎস্য সংরক্ষেনের প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকার অভাবে তাদের কষ্টার্জিত মৎস অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। যদি উয়িন্ডমিল প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যৃৎ উৎপাদন করে উপকূলীয় মানুষদের দোরগোড়ায় বিদ্যুৎ পৌছে দেয়া সম্ভব হয় তবে উপকুলীয় অঞ্চলের এসব মানুষদের সমস্যা বহুলাংশে সমাধান করা সম্ভব। এটি শুধু উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন সাধন করবে না, বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
No comments:
Post a Comment