স্বর্গে কি দিনরাত আছে ?
হুম...,আছে বোধ হয় ।
থাকলে কোনটাতে বেশি সময় কাটাতে ?
তুমি কোনটা ?
আমি রাতে , রাত পরিপূর্ণতায় ভরা,রহস্যে মোড়া । দিন খালি খালি ,ধুলোবালিময় আর ফ্যাকাশে ।
জোনাকি গুলো ঘিরে ধরেছে প্রাঙ্গন নিশিতাকে । মাথায় বিলি কাটছে বাতাস ,আর জোছনাটা মাথা ভেদ করে স্নায়ুতে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রশ্ন করে প্রাঙ্গন , উত্তর ও দেয় সেই । নিশিতা শুধু প্রবাহতা ধরে রাখে গল্পের ।প্রাঙ্গন ঝর্নার ছল ছল জল, নিশিতা গতি পথের বালি পাথর ।প্রাঙ্গন প্রশ্ন করে ,
--বাড়ি যাবে না ?
--তুমি কখন যাবে ?
--এইত কিছুক্ষন পরেই ।
--আচ্ছা ,চাঁদটা কি সুন্দর ,কলঙ্কে ভরা ,তবু সুন্দর । মহৎ মানুশের জীবনের মত ,আলোকিত জীবনের কষ্টের উপাখ্যান ঐ কলঙ্ক ।
প্রাঙ্গন অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় নিশিতার দিকে । ঠোঁট গুলো কি পাতলা ,মনে হয় গোলাপের লাল পাপড়ি , এখনি বাতাসে কেঁপে উঠবে । হঠাৎ কুঞ্চিত হয়ে উঠে প্রাঙ্গনের মায়াময় চোখ জুড়া ।নিশিতা বলে এই চোখ জুড়াই আমাকে প্রথম ধাধিয়ে ছিল,এখন মাতিয়ে রেখেছে । নিশিতার চোখ গুলো কিশোরী বুলবুলির মত ভেজা ,চাহনিতে কাতরতা।
--তোমার চোখের আধার গুলো কিসের ?
--জানি না । আধারকে তুমি ভয়ঙ্কর ভাব ?
--হ্যা,ভয়ঙ্কর সুন্দর । আর ভয়ঙ্কর সুন্দরে নেশা হয় ।
--কাব্য ছাড়, আমার চোখে সুরা-শিশির জমে নি । চল বাড়ি যাই
--আরেকটু বসি ।
প্রাঙ্গন গতকাল রাতে দেখেছিল একটি মেয়ে ,দুখিনি মেয়ে ,পায়ে হাতে শিকল বাঁধা । অশ্রু ভেজা শিকল কপোলে ছোঁয়ায় কঠিন শীতল পরশ ।কে কাঁদছিল ,মেয়েটি কে ছিল ? মেয়েটির আধার ঘন চুলের আড়ালে চোখ খানা ছড়াচ্ছিল অগ্নি বাষ্প , জ্বলজ্বল করছিল নিশাচর অশরীরীর মত ।
প্রাঙ্গন কবিতা লিখে । শব্দের বুননে গড়ে তুলে নিশিতার দেহ । শ্রবনে তানপুরার মত নিশিতার মন কেঁপে উঠে । পরম চেনা সুর ,প্রজাপতির তবু না জানার বাহানা ফুলের সাথে । কবিতার প্রতি লাইনে জমে আছে সুখ, পরাগে রেণুর মত। নিশিতার কাছে প্রাঙ্গণকে রহস্যময় মায়া মনে হয় ।একে মায়া , আবার রহস্যময় ! মনে হয় চেনেইনা ওকে। অথচ কি আজব ! ওর সাথেই পরম বিশ্বাসে নিশ্চিন্তে থাকছে ।বিশ্বাস বড় সর্বনেশে । পাগলের মত ভালবেসে যাচ্ছে প্রাঙ্গণকে ।
প্রাঙ্গন তাকিয়ে থাকে বক্র ভ্রুর মিলন তটে , যেখানে নিশিতা পরে আছে লাল-কালো টিপ , টিপ থেকে উপরে যেখানে চুম্বন আঁকা যায় ।প্রাঙ্গনের কিছু অবাস্তব বিশ্বাস আছে । তার বিশ্বাস মানুশকে নিয়ে, মানুশের মস্তিষ্ক নিয়ে ,মস্তিষ্কের শক্তি নিয়ে । মানুষ অবিশ্বাস্য রহস্যে মোড়া , অলৌকিক , অথচ অবিশ্বাস অলৌকিকে । কয়েকশ বছর আগেও এখনকার প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান বিশ্বাসের দায়ে মানুষ ঝুলেছে ফাসির কাষ্ঠে ,অগ্নি দহন হয়েছে । তখনকার মানুষ কি ভাবতে পারত একবিংশ শতাব্দীর কেউই বিশ্বাস করবে না সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে ? তারা নিজেদের নিয়ে গর্বিত ছিল তাদের পূর্বপুরুষের থেকে নিজেদের বিজ্ঞান নিয়ে, বুদ্ধির অগ্রসরতা নিয়ে ; প্রত্যেক শতাব্দীর মানুশের মতই । আমরাও গর্বিত আমাদের বিজ্ঞানের শুচিতা নিয়ে , পূর্ব পুরুষের নির্জন চর্চার বিজ্ঞানে অবিশ্বাস নিয়ে । আমরা তাকে ধূর্ততা বলি, লোক ঠকানোর গল্প বলি ।
প্রাঙ্গন বিশ্বাস করে , দুই শ বছর পরে মানব প্রজন্ম আফসোস করবে কোন নির্বুদ্ধিতায় আমরা ব্ল্যাক ম্যাজিক ,টেলিপ্যাথি ,হিপ্নোটাইসিস , মত ব্যাপার গুলো অবৈজ্ঞানিক ভেবে পাশ কাটালাম !কেন পাশ কাটালাম সম্ভাবনাময় অলৌকিকতাকে ? এসবত ছিল আনুষ্ঠানিকতার ধূলায় মোড়া জ্বলজ্বলে হীরে । আমরা কেবল ধুলো দিয়েই হাত নোংরা করলাম । প্রাঙ্গন বলে, আমাদের বর্তমানের বিজ্ঞান কেবল বস্তুগত , যেখানে বস্তুকণা নেই সেখানে হিমশিম খেয়ে যায় । দুনিয়াকে কেবল বস্তু বোঝাই দেখলাম ,এই কি সব ? মোদ্দা কথা , আমাদের প্রচলিত বিজ্ঞান বাদে অন্য এক ধরনের বিজ্ঞান আছে যা ব্যাখ্যা করতে পারে অলৌকিকতাকে । অথবা আমাদের বিজ্ঞান নদী ঐ নদির মোহনায় মিশতে পারে ভবিষ্যতে ,তখন আমাদের বিজ্ঞান পুরনো হয়ে উঠবে ,সেকেলে হবে কালের চক্র পিষ্ঠে । এই বিশ্বাস নাড়া দেয় প্রাঙ্গন কে ।
প্রাঙ্গন কবিতা লিখত আগে থেকেই । কবিতার মণ্ডপে পূজো দিতে ফুল খোজত প্রকৃতির শ্যামল বুকে ,মানুশের চোখে । সে মানুশের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে করতে বুঝতে পারল মানুশের চরিত্রে কাঠামো গত মিল আছে । যেসব মানুশের চেহারাগত সাদৃশ্য থাকে তাদের বেশির ভাগেরই আচরন গত সাদৃশ্য আছে। যে মানুষকে যত বেশি দিলখোশ হয়, তার দুঃখ গুলো জমাট বাঁধা পাহাড় হয় ।মানুশের এমন কিছু প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে যা তার অন্য বৈশিষ্ট্য গুলোকে প্রভাবিত করে । প্রাঙ্গনের মনে হত প্রত্যেক মানুষ এক একটি গল্প ,তার কয়েকটা মাত্র কাগজে ধরে । অনেক বৈশিষ্ট্যের সম্ভার থেকে মাত্র সাত-আটটি নিয়ে একটি উপন্যাস হয়ে যায় । সে মানুশের চোখ দেখে বুঝতে চাইত সে কেমন অবস্থার মধ্যে আছে । ধীরে ধীরে তার মনে হতে লাগল তার কোন একটা অস্পষ্ট অনুভূতি হচ্ছে ,যে অনুভুতির ভাষা আছে , কিন্তু সে বুঝতে পারছে না ।
সে শুনল সম্মোহনের কথা , যে প্রক্রিয়ায় অপরের মস্তিস্ককে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।রামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দ কে সম্মোহিতো করেছিলেন। একজন হিন্দু সাধক রেগে গিয়ে পাপাচারী বকের দিকে রাগী দৃষ্টি দেয়াতে বকের মৃত্যু হয়। সব ই গল্প , কোন সত্যতা নেই ? সে চিন্তা করলো ঠাকুরের ললাটে অঙ্কিত বর্শা , কেন আঁকা হয় ? নামাজী ব্যাক্তির কপালের কালো দাগ থেকে আখিরাতে নূর বের হবে । নূর মানে আলো ,আলো মানে শক্তি । কপাল থেকে শক্তি বের হতে পারে ? সে চিন্তা করলো , মানুষ হাত নাড়াতে চাইলেই শক্তি হাতে প্রবাহিত হয় । এই ইচ্ছা শক্তি নিজ দেহের ভেতরে যেমন গাড় ভাবে কাজ করে দেহের বাইরে কি করবে, দেহের বাইরে কি আনা যায় না ? সে পরীক্ষা করতে চাইল পিঁপড়াদের উপর । পিঁপড়ার সারির একটি পিঁপড়ার দিকে তাকিয়ে একাগ্র চিত্তে চিন্তা করতে থাকল , আমার কপালের বর্শা স্থান হতে শক্তি বের হও , পিঁপড়াটা থেমে যাক । পিঁপড়া চলে গেল । সেদিন প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে বাড়ি চলে গেল প্রাঙ্গন । টানা তিন বছর সে এই চেষ্টা করেছে । ধ্যান করে নিজের চিন্তাকে একাগ্র করেছে, চেষ্টা করেছে একাগ্র চিন্তা রশ্মি দিয়ে পিঁপড়াটাকে থামিয়ে দিতে ।
নিরাকার ঈশ্বর যদি মুসাকে(আঃ) আঙুল দেখান এই ভেবে যে অন্য কিছু দেখালে মানুষ বুঝতে পারবে না তিনি কি দেখালেন ,চোখ , নাক না পা , তাহলে তিনি আমদেরকে যেসব অলৌকিক জ্ঞান দেখিয়েছেন আমাদের সাধ্যের মধ্যে ভেবেই ,সময়ে অলৌকিকতা বিজ্ঞান হয়ে যাবে , মানুষ নিজেদেরকে জ্যোতির্ময় করে তুলবে । প্রাঙ্গন এই বিশ্বাসেই চেষ্টা করে যেতে লাগল ।আরও কয়েকবছরের সাধনায় সে পিঁপড়ার দুনিয়া দেখতে পেল । কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে পিঁপড়া মনে হল । সে বুঝতে পারল সে পিঁপড়ার মনকে স্পষ্ট পড়তে পারছে , পিঁপড়ার চোখে দেখতে পারছে । আর একদিন একটি পিঁপড়া সত্যিই থেমে গেল ! সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে অন্য মনকে !অন্য আত্মাকে !
প্রাঙ্গন স্পষ্ট পড়তে পারছিল নিশিতাকে, নিশিতার চিন্তাকে । নিজেকে নিজের ভালবাসার থেকে ছোট মনে হল । নিশিতা আমাকে রহস্যময় ভাবছে কেন ? আমার চোখ তাকে এতো ভাবাচ্ছে কেন ? যখনি সময় হত নিশিতার সাথে সময় কাটাত ও। খুব ভালবাসত নিশিতাকে । প্রাঙ্গন চোখ বুজলেই নিশিতাকে স্পষ্ট দেখতে পেত । সে বন্ধ চোখের লাল পর্দায় দেখতে পারত নিশিতাকে ।
-আমি তোমাকে খুব ভালবাসি । হঠাৎ নিশিতা কথা বলে উঠল । প্রাঙ্গন ভাবলেশহীন ভাবে বলল ,আমি জানি । আমিও তোমাকে ভালবাসি ।
কয়েক দিন ধরে একটি সমস্যায় পরেছে প্রাঙ্গন । নিশিতা যতক্ষণ জেগে থাকে , প্রাঙ্গন তত ক্ষণ দূর হতেও দেখতে পারে নিশিতা কেমন আছে ,কি করছে । কিন্তু যখন ঘুমে থাকে তখন দেখে একটি মেয়ে কাঁদছে । প্রাঙ্গন বুঝতে পারল মেয়েটি নিশিতা । প্রাঙ্গন দৌড়ে নিশিতার বাড়ি গিয়েছিল কাল রাতে । জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল নিশিতা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে । জোছনার আলোয় কেমন মায়াবী লাগাছিল নিশিতার চোখ জোড়াকে ! প্রাঙ্গন চোখ বুঝে আবার দেখে নিশিতা কাঁদছে । কাঁদছে কেন ও ? কিসের দুঃখ ওর ?আমি ওর দুঃখ জানতে পারছি না কেন ? প্রাঙ্গনের মনে হাহাকার বয়ে যায় । চাঁদের আলোয় নিজের ছায়াটাকে প্রেতাত্মা মনে হল। প্রাঙ্গন নিশিতাকে খুব ভালবাসত । নিশিতা অনেকটা পাশ কাটিয়ে চলত প্রাঙ্গণকে । প্রাঙ্গন যখন আত্মা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে তখন নিশিতাকে ভালবাসতে বাধ্য করে । নিশিতা ভালবাসতে থাকে । কিন্তু নিশিতা কই ? এতো প্রাঙ্গনেরি উপ-রুপ ,নিশিতার মন প্রাঙ্গনের মনের ছাঁচে গড়া পুতুল । প্রাঙ্গন বুঝতে পারে , নিশিতা যখন ঘুমে থাকে , তখনই কেবল তার ভালবাসার নিশিতাকে দেখতে পারে , যে নিশিতা দুখিনি , শিকলে বন্ধী। নিশিতাকে ও বন্ধী করে ফেলেছে । নিজের ভালবাসা স্বার্থপর হয়ে উঠেছে । নিশিতা স্বতন্ত্রতা হারালে সে কাকে ভালবাসছে ? একটি পুতুলকে ? যে নাচতে চাইলে নাচে কখনো নাচায় না , ভুল করে বুকে এসে পরে না , অভিমান জানে না , আবদার জানে না , চিমটি কাটে না , ভালবাসায় বাকি রইল কি আর ? প্রাঙ্গন ঠিক করে ছিল আজকেই তাদের শেষ একসাথে বসা । মুক্ত করে দিবে নিশিতাকে ।প্রাঙ্গন নিশিতাকে কিছুই বলল না । দুজন দুজনার বাড়ির পথে আলাদা হয়ে গেল ।
রাত্রি দুটা তখন । প্রাঙ্গন একাই বসে ছিল বাসার নির্জন ছাদে । দেখল , নিশিতা কাঁদছে । আনমনে বলে উঠল ,"কেঁদো না নিশিতা । আমি গোলাপ কাঁটা সরিয়ে নিলাম । গোলাপটাও তোমার ইচ্ছার অধীন করে দিলাম ।" নিশিতাকে মুক্ত করে দিল সে ভালবাসার কারাগার থেকে । সে তাকে হেসে উঠতে দেখল খিক খিক করে । নিশিতার সুন্দর হাসি এখন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে । নিশিতার কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরল ও। গভীর ঘুম । সে ভেবেছিল আজ রাতে আর ঘুম আসবে না । নিশিতা আর তার কথা ভাববে না , তার জন্য বসে থাকবে না ,পৃথিবীতে সে মূল্যহীন হয়ে পরবে । চিন্তার প্রচণ্ডতা ঘুমাতে দিবে না তাকে । কিন্তু সে ঘুমিয়ে পরল নিজের অজান্তেই নির্জন ছাদে চাঁদোয়ার জোছনা জলের মাঝে । হাতের আধ খাওয়া সিগারেটখানা নিভে গেল ধীরে ধীরে । হা হা করে দখিনা বাতাস বইছিল তখন ।
--এই প্রাঙ্গন !
--কে ? নিশিতা ?
--হুম... , আমি তোমাকে ভালবাসি ।
--আমি ও ।
--কাল থেকে তুমি আর বাসবে না ।
--কেন ?
--কারণ কাল থেকে আমিও আর তোমাকে ভালবাসব না ।
--আমি বাসব । আমি তোমার জন্য পৃথিবীতে স্বর্গ বানাবো ,তাজমহলটা লজ্জায় গুঁড়ো হয়ে যাবে ।
- -তুমি চাইলেও পারবে না । কারন , আমি চাইব তুমি বাসবে না ,আমাকে ভুলে যাবে ।.........প্রাঙ্গন ......
প্রাঙ্গন নিশ্চুপ । বন্ধ চোখ থেকে অশ্রুরা পথ করে নিয়েছে ।
আমি তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি প্রাঙ্গন । তোমার থেকে শেখা কৌশলে তোমাকেই হারিয়ে দিয়েছি ।আমিই তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করছি । তুমি আমাকে মুক্ত করনি প্রাঙ্গন , আমি নিজে মুক্ত হয়েছি ।
প্রাঙ্গনের স্বপ্ন থেকে নিশিতা মুছে গেল । চাঁদোয়াটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল অশ্রুর গতিপথে । বুকে জোছনা নিয়ে গড়িয়ে পরল আরও এক ফোঁটা অশ্রু ।
No comments:
Post a Comment